অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজে সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, আমাদের দলের পক্ষ থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো টাইমফ্রেম (সময়সীমা) বেঁধে দেওয়া হবে না। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে তারা যেভাবে চাইবে, সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি আরও বলেন, অতীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। এক ব্যক্তির শাসনের নামে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেওয়া হয়েছে, স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেওয়া হয়েছে। এর অবসান ঘটাতে হবে। সংবিধান ও শাসন পদ্ধতিতে যে ত্রুটি রয়েছে, তা দূর করতে হবে। নির্বাচনব্যবস্থা ও শাসনতন্ত্র সুষ্ঠু করতে হবে। প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। ট্রুথ কমিশন গঠন করে স্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরতের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। রোববার রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের এসব কথা বলেন। শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে তুলে ধরতেই মূলত জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, মোস্তফা আল মাহমুদ, মনিরুল ইসলাম মিলন, মাসরুর মওলা, জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মো. খলিলুর রহমান খলিল, মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমান, সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। জিএম কাদের বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে তারা যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের ধারণা নির্বাচিত সরকারের চেয়ে অনির্বাচিত সরকার বেশি সুশাসন দিতে পারে। আমরা মনে করি, দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। পুলিশের ভয়ভীতি দূর করে তাদের মাধ্যমে মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের যদি পেটের ভাত ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তাহলে তারা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি আছে। সরকার যেভাবে চাইবে, আমরা সংস্কারের জন্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, অনেক বেশি মামলা হচ্ছে। এত মামলা হলে প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যাবে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানাবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ দাবি আমি আগেই করেছি, যা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। জিএম কাদের বলেন, আমরা শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছি। জাতীয় পার্টি সব সময় জনগণের পক্ষে ছিল এবং আজীবন থাকবে। একটি পক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে জাতীয় পার্টির দোষারোপ করে, যা আসলেই ঠিক না।
জিএম কাদের বলেন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেছিল। যে নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু ২০০০ সালে আওয়ামী লীগের শেষ বছর বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। একইভাবে র্যাব দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও দুর্নীতি দুঃশাসনে দেশের মানুষ অস্থির হয়ে পড়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে পরপর চারবার দেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায়ও নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দলীয়করণের চেষ্টা হয়েছিল। এক-এগারোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা মহাজোটের অংশ ছিলাম। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। ফেয়ার নির্বাচনে সেসময় বিএনপির অবস্থা খুবই নাজুক হয়েছিল। মহাজোট গঠনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল বিচারবহির্ভূত হত্যা, দুর্নীতি ও দলীয়করণ এবং নির্বাচনব্যবস্থা প্রভাবিত করা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগ কথা রাখেনি, তারা তাদের মতো করে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচন করেছে।
তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কারণ, সংবিধানে এক ব্যক্তিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দেশে স্বৈরশাসন সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা থাকলে দল, সরকার ও রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের বিপক্ষে চলে যায়। এক ব্যক্তি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে তার মধ্যে একনায়কতন্ত্র কায়েম করার চিন্তা আসে। তাই আমরা চাই, কোনো ব্যক্তি যেন দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা একেবারে শূন্য করা হয়েছে। আমরা চাই, সংসদে চারভাগের তিনভাগ ভোটে যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, তাহলে যে কোনো সরকারপ্রধান তাকে যখন-তখন অপসারণ করতে পারবে না। এখন প্রায় সব ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়, আমরা এর বাতিল চেয়েছি। আমরা চাই, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় রাষ্ট্রপতি একটি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দেবেন। আমরা চাই, রাষ্ট্রপতি তার জায়গা থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, নিম্ন আদালত রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে। সংবিধানের ১১৬ ধারা বাতিল করা উচিত। নিম্ন আদালতের ব্যাপারে সব ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে দেওয়া উচিত। উচ্চ আদালতের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি দেবেন। কিন্তু তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে পাশ হতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনার যারা নির্বাচিত হবেন, তাদের মিনিমাম একটা কোয়ালিটি নির্ধারণ করতে হবে আইনের মাধ্যমে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল রেখে কোনো সংশোধন করা সম্ভব নয়। তাই সংবিধান সংশোধন করতে হলে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে। অথবা নতুন করে সংবিধান রচনা করতে হবে। মামলা করলে পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ হতে পারে। সংবিধানের কিছু অংশ পরিবর্তন করা যাবে না, এটা কখনোই হতে পারে না।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ১ জুলাই থেকে শুরু হয়। ৩ জুলাই সংসদ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে আমি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসাবে কোটার বিরোধিতা করে বক্তৃতা করেছি। আমরা সব সময় বলেছি কোটা পদ্ধতি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি। আমরা বলেছি, বৈষম্যবিরোধী যে কোনো আন্দোলনে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারে। কোটা পদ্ধতি ছিল সংবিধান পরিপন্থি। কারণ, সংবিধানে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বরাদ্দের কথা আছে; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নেই। ৬ জুলাই গাজীপুর জাতীয় পার্টির সম্মেলনে আমি ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছি তোমরা শহিদ মিনারে যাও- শহিদ মিনার হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উজ্জ্বল প্রতীক। এছাড়া প্রতিদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছি। ছাত্র ও ছাত্রীদের ওপর পুলিশ এবং সন্ত্রাসীদের হামলার নিন্দা জানিয়েছি প্রতিদিন। আন্দোলন চলাকালে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এবং উপযুক্ত বিচার চেয়ে বক্তৃতা ও বিবৃতি দিয়েছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের যখন আটকে রাখা হয়েছিল, আমরা তাদের মুক্তির দাবি জানিয়েছি।
জাতীয় পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দলের রাজনীতি আমাদের মতো করে করতে দেয়নি স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমরা আওয়ামী লীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের দল হয়তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; কিন্তু দলটি বেঁচে গেছে। দল না থাকলে আমাদের রাজনীতি থাকবে না। তাই দল বাঁচানো আমাদের কাছে জরুরি ছিল। নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনের পরও আমরা বলেছি, নির্বাচন সঠিক হয়নি। কোনো কোনো আসনে সরকার হস্তক্ষেপ করেনি। কোথাও কোথাও সরকারের নির্দেশনা ছিল যে যেভাবে পারো জিতে আসো। সেখানে কালোটাকা বা পেশিশক্তি কোনো বিষয় ছিল না।
জিএম কাদের বলেন, তৃতীয় নির্দেশনা ছিল নির্বাচনে যে যাই করুক, তাদের তালিকা অনুযায়ী বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের পর বক্তৃতা ও প্রবন্ধে আমরা প্রমাণ করেছি ওই সময়ে কোনোভাবেই এত ভোট কাউন্ট হওয়া অসম্ভব। সংসদ এবং সংসদের বাইরে আমরা এসব কথা বলেছি। আমাদের দল ও সংসদীয় দলকে সব সময় আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জনের জন্য সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আমাকে সেই সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে দেয়নি।