দাদন ফকির পুলিশে ঢুকেই ‘বাদশাহ’

রিপোর্টার :
  • আপডেট সময় : সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
  • ১২০ সাংবাদটি পড়া হয়েছে

১৯৯৭ সালে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) পদে চাকরিতে যোগ দেন দাদন ফকির। পরে দুই ধাপে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হন। এএসপি পদে পদোন্নতি পেলেও ‌‌‘ওসি দাদন ফকির’ নামেই তাঁর পরিচিতি। তিনি রাজধানীর মিরপুর, পল্লবীসহ কয়েকটি থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার সময়ে ছিলেন তিনি অত্যন্ত ‘দাপুটে ওসি’। কমিশনারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বেশ আলোচনায় ছিলেন সে সময়। যে থানায় যেতেন, হয়ে উঠতেন সেখানকার ‘বাদশাহ’।

সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী হিসাব করলে পুলিশে চাকরি শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত দাদন ফকির বেতন পেয়েছেন সর্বোচ্চ এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু পুলিশের এ কর্মকর্তার ঢাকায় রয়েছে বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ি। শুধু তাই নয়, ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জে রয়েছে দুটি প্লট। মাদারীপুরে বহু টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছেন তিনতলা বাড়ি। এসব ছাড়াও তাঁর রয়েছে মার্কেট, বাগানসহ বিপুল সম্পদ। সমকালের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এর বাইরে বেনামেও তাঁর বিপুল সম্পদ আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

দাদন ফকিরের এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৈতৃক সূত্রেও তিনি সম্পদশালী ছিলেন না। গ্রামে টিনের বাড়ি ছিল তাদের। এখন গ্রামে তাঁর সুরম্য বাড়ি। সঙ্গে দামি দামি বহু জমি।
দাদন ফকির ২০১৫ সালের ১৬ মে থেকে ২০১৮ সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত পল্লবী থানার ওসি ছিলেন। সেখান থেকে বদলি হয়ে মিরপুর থানার ওসির দায়িত্ব পান। ঢাকায় আসার আগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ওসি ছিলেন তিনি।

পুলিশের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে দাদন ফকিরের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া ঢাকার পল্লবীতে ওসি থাকাকালীন জমি দখলে সহায়তাসহ নানা অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। সে সময় মাদক মামলায় প্রকৃত আসামিকে না ধরে পল্লবীর বেনারসি কারিগর মো. আরমানকে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানা পুলিশ। নির্দোষ হয়েও আরমানকে ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তিন বছর কারাভোগ করতে হয়। এ ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে দাদন ফকিরসহ ৭ পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানীর রূপনগরে ইস্টার্ন হাউজিংয়ে (পল্লবী দ্বিতীয় পর্ব) দাদন ফকিরের একটি বাড়ি আছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর সকালে হাউজিংয়ের প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকে কিছুদূর এগিয়ে একজন দোকানদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এএসপি দাদন ফকিরের বাড়ি কোনটি? দোকানের সামনে থাকা এক যুবক পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘ওসি দাদন ফকিরের বাড়ি?’ হ্যাঁসূচক জবাব পেয়ে সেখানে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেন তিনি।

সি-ব্লকের ডব্লিউ/২ রোডের ১১১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৬ তলা বাড়িটিই দাদন ফকিরের। নাম ‘সুলতানা মঞ্জিল’। স্ত্রী জাকিয়া সুলতানার নামে বাড়ির নাম। ভবনের বাইরের কাঠামো ও রঙে বেশ আভিজাত্য। আশপাশের অন্য বাড়ির তুলনায় এটি চোখে পড়ার মতো।

হাউজিংয়ের কয়েক বাসিন্দা জানান, দাদন ফকির কয়েক বছর আগে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন। তাদের ধারণা, কম করে হলেও তিন কোটি টাকা খরচ করেছেন তিনি।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ইকুরিয়া মৌজায় দাদন ফকিরের দুটি জমির তথ্য নিশ্চত হওয়া গেছে। ৯০৩ নম্বর খতিয়ানের একটি দাগে ৬ শতক এবং ৩১৫ নম্বর খতিয়ানের একটি দাগে সাড়ে ৪ শতক জমি রয়েছে। প্লট দুটি দাদন ফকিরের নামেই কেনা।

ঢাকায় নিজের প্রাইভেটকারে চলাফেরা করেন দাদন ফকির। গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-৩৯-৯৬৪৩। ২০১৫ সালে সেটি কেনেন তিনি।

দাদন ফকিরের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর থানার চর শ্যামাইলে। ১৯৯১ সালে এসআই পদে ২৮৭ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগে একই বছর ওই নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়। বাতিলের তালিকায় দাদন ফকিরও একজন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে এক নির্বাহী আদেশে দাদন ফকিরসহ ১৭১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত চাকরির বাইরে থাকলেও সে সময়ের বেতন-ভাতা ও জ্যেষ্ঠতা পান তারা। চাকরির শুরুতে দাদন ফকিরের বেতন ছিল আড়াই হাজার টাকার মতো। ২০১০ সালের দিকে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এএসপি হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি। সর্বশেষ তাঁর বেতন ছিল ৭০ হাজার টাকার মতো। সে হিসাবে ১৯৯১ সাল থেকে এখন অবধি সরকারের কাছ থেকে বেতন পেয়েছেন সর্বোচ্চ এক কোটি ২৫ লাখ টাকা।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর শিবচরের চর শ্যামাইল গ্রামে কথা হয় দাদন ফকিরের এলাকার অনেকের সঙ্গে। তারা জানান, দাদন ফকিরের প্রয়াত বাবা আব্দুল খালেক ফকির ইউপি সদস্য ছিলেন। ৮ ভাইবোনের মধ্যে দাদন চতুর্থ। আট সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালিয়ে খালেক ফকির সঞ্চয় তেমন করতে পারেননি। গ্রামে সব মিলিয়ে আব্দুল খালেক ফকিরের ১০-১২ বিঘা জমি ছিল। সেই জমি দাদন ফকিরসহ তাঁর ৫ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ভাগ হয়েছে। দাদন পৈতৃক জমির ভাগ পাওয়ার কথা সর্বোচ্চ দুই বিঘা।

সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামে দৃষ্টিনন্দন তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন দাদন ফকির। ভবনটি থেকে ঢালাই রাস্তা এসে ঠেকেছে সরকারি সড়কে। সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে করা হয়েছে সুন্দর ফটক। বাড়ির প্রাঙ্গণ গাছগাছালিতে ভরা। বাড়ির বিপরীত দিকে আনুমানিক ১২ শতাংশ খালি জায়গা পড়ে আছে। জায়গাটির চারপাশে পিলার দেওয়া। স্থানীয়রা জানান, জায়গাটি দাদন ফকিরের।
বাড়ি থেকে একটু সামনে এগোলেই পড়ে চর শ্যামাইল বাজার। সেখানে পাওয়া গেল ফকির মার্কেট, যেটির মালিক দাদন ফকির। মার্কেটের পুরো জমি (প্রায় ১৫ শতাংশ) তাঁর কেনা। এ মার্কেটে প্রাথমিকভাবে আটটি দোকান করা হয়েছে। তার মধ্যে একটিতে তাঁর এক ভাই মুদি দোকান দিয়েছেন। অন্য দোকানগুলো ভাড়া দেওয়া।

মার্কেটের পাশেই ২০১২-১৩ সালের দিকে ৬০ শতাংশ জমি কেনেন দাদন ফকির। সেখানে মেহগনি গাছের বাগান করেছিলেন। পরে গাছগুলো কেটে জায়গাটি খালি করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, চর শ্যামাইল বাজারসংলগ্ন একটি জায়গা ছিল আলেপজান নামে এক বিধবা নারীর। সামনে দোকান আর পেছনে তাঁর ঘর ছিল। দোকানঘর ভাড়া দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতেন তিনি। কয়েক মাস আগে আলেপজানের সেই জমি দাদন ও তাঁর পরিবার জোর করে দখলে নিয়েছেন। তবে বিনিময়ে বাজারের শেষ প্রান্তে কম দামি একটি জায়গা দেওয়া হয়েছে আলেপজানকে।

এ ব্যাপারে জানতে আলেপজানের বাসায় গিয়ে তাঁর খোঁজ করে সমকাল। বাসায় ছিলেন না তিনি। ফেরার পথে রাস্তায় দেখা মেলে তাঁর। জমি নিয়ে কী সমস্যা হয়েছে– প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বলে লাভ কী হবে! বিচার দিছি আল্লার কাছে। বাজারের সঙ্গে আমার জমি ছিল। সেই জমি এলাকায় ওসির পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কেউ নেই। সবাই ভয়ে থাকে।’
চর শ্যামাইলে পৌরসভা ভবন-২ এর কাছেই একটি মাদ্রাসা। নাম মারকাযুন নূর মাদ্রাসা। প্রায় ২০ শতাংশ এই জায়গার মালিক দাদন। জায়গাটি মাদ্রাসাকে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। একই এলাকায় আরও প্রায় ২০ শতাংশ জায়গা কিনেছেন দাদন ফকির। এ ছাড়া শিবচর বাজারে ৭১ নম্বর সড়কে ৪৪ নম্বর দোকানঘরের মালিক দাদন ফকির। দোকানটি ভাড়া দেওয়া আছে। পাশাপাশি শিবচর দাদা ভাই মার্কেটে দুটি দোকান এবং দাদা ভাই উপশহরে একটি প্লট রয়েছে তাঁর।

এক সময়ের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা দাদন ফকির সর্বশেষ ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গতকাল রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার।

এসব বিষয়ে মন্তব্য নেওয়ার জন্য দাদন ফকিরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁর মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যরা যা পছন্দ করছে
© All rights reserved © 2024 bdnews24us.com