দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তথা অর্থনীতির প্রাণ পোশাক খাত। রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা শ্রম অসন্তোষ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য যেন নিয়তি। তবে এতোদিন শ্রম অসন্তোষ হলেও তা সহজেই সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ করে এই খাতে শ্রম অসন্তোষ সৃষ্টিতে উঠে পড়ে লেগেছে তৃতীয় শক্তি বিশেষ করে পোশাক খাতের প্রতিদ্বন্দী দেশ ভারত। দিল্লিতে পলাতক শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারকে অচল করার সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ড হিসেবে নিয়েছেন দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে। এর আগে জুডিশিয়্যাল ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচারণা, ১৫ ও ২১ আগস্টে ঢাকায ১০ লাখ লোকের সমাগম করে সরকারকে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, সরকারি কর্মচারীদের দাবি দাওয়ার আন্দোলনে রাস্তায় নামিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি ও আনসার বাহিনী দিয়ে সচিবালয় ঘেড়াও ষড়যন্ত্রে সফল হতে না পেরে এখন সর্বশেষ শ্রমিকদের দিয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সরকার অচল করে দেয়ার অপচেষ্টায় নেমেছে। শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে কারখানা বন্ধ ও উৎপাদন ব্যাহত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ফ্যাসিস্ট হাসিনার একটি চক্র। যাতে সময়মতো পণ্য বুঝে পেতে উদ্বেগ তৈরি হয় ব্র্যান্ড-ক্রেতাদের। ক্ষুন্ন হয় দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ। সর্বশেষ চলমান অস্থিরতা পোশাক খাতকে আরেক দফা বিপাকে ফেলেছে। অনেক ক্রেতা রপ্তানি আদেশ সরিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশের বিকল্প দেশে। তবে এবার সোচ্চার হয়েছে সরকার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই। ইতোমধ্যে অস্থিরতা তৈরির সঙ্গে জড়িত এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তবে এ যাত্রায়ও স্বৈরাচার হাসিনা সফল হতে পারবেনা বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার, মালিক, শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডাররা। আর তাই এই শিল্পকে নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র হলে তা কঠোরতার সঙ্গে দমন করা হবে বলে সম্মিলিত হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেছেন, রোববার দেশের সব তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা খোলা থাকবে। কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে সরকার। দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কেউ যদি কারখানা বন্ধ রাখার অপচেষ্টা করেন, সেটাও মনে রাখা হবে।
শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ভবনে এক মতবিনিময় সভায় শিল্প উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। তৈরি পোশাক কারখানায় চলমান সঙ্কট ও উত্তরণের পথ নিয়ে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিজিএমইএ। সভাপতিত্ব করেন বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, শ্রম সচিব এইচ এম শফিকুজ্জামান, সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান, শিল্প পুলিশের প্রধান সিবগাতউল্লাহ, নিট পোশাক কারখানা মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ প্রমুখ।
বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকে শ্রমিক অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে হামলা-ভাঙচুর অব্যাহত থাকলে এবার কারখানা বন্ধের হুঁশিয়ারি এসেছে তৈরি পোশাক শিল্প মালিক ও রফতানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর পক্ষ থেকে। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ায় আজ রোববার সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে আগামী পরশু দিন থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। বিজিএমইএ সভাপতির এই বক্তব্যে উপস্থিত পোশাক মালিকরা একই অভিব্যক্তি পোষণ করেন। তিনি বলেন, রোববার কারখানা চালু রাখা হবে। তখন যদি কোনো কারখানায় হামলা, ভাঙচুর হয় শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিলে আশুলিয়ার কারখানা মালিকেরা কারখানা বন্ধ করে দেবেন। তার এমন ঘোষণায় সমর্থন দিয়ে নিট পোশাক কারখানা মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ সংগঠন এই ঘোষণাকে সমর্থন দিলাম। ভাঙচুর হলে আশুলিয়ার কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে।
উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, তৈরি পোশাক খাতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকার কমিটি করেছে। এই কমিটির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার যে সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে।
শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় অনেকের মতো শ্রমিকেরাও নিজেদের কথা বলছেন। শ্রমিকদের অভিযোগ সমাধানে শ্রমসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সব অভিযোগ ও দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে শ্রমিকের আন্দোলনে একদমই যে ষড়যন্ত্র নেই, এমনও নয়।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ইতিমধ্যে শ্রমিকদের জন্য কোন প্রক্রিয়ায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় ৪ জনকে গুলি করে হত্যা ও যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্রম আইনের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার যতটা সুযোগ আছে, তা নিশ্চিত করবে সরকার। তবে এই সব প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে শ্রমিকদের বলছি, সবাই স্বাভাবিক কাজে আসুন। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন।
অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, যারা শিল্পাঞ্চলগুলোতে অযৌক্তিক দাবি আদায়ের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পোশাক খাতকে রক্ষা করা দেশপ্রেমের অংশ। দেশকে ভালোবাসলে এই খাতকে রক্ষা করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ফরিদা আখতার বলেন, যারা ভাঙচুর ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করছেন তাদের প্রতি আহ্বান, এগুলো বন্ধ করুন। যদি বন্ধ না করেন আপনাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পে অসন্তোষ হয়েছে; তা সমাধানের জন্য মালিক-শ্রমিক সবাই মিলে আমরা কাজ করব।
পোশাক খাতকে শ্রমনির্ভর শিল্প উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা একমাত্র শিল্প যেটা সম্পূর্ণভাবে শ্রমনির্ভর, আর এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পোশাক খাতের জন্য বাংলাদেশকে মেড ইন বাংলাদেশ নামে বিশ্ববাসী চেনে। যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশেষ করে এই খাতের নারী শ্রমিকদের অনেক অবদান।
ফরিদা আখতার বলেন, বাংলাদেশ যে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে এজন্য মালিক-শ্রমিক সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তাদের কারণেই দেশের পোশাক খাত আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এই অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কেন থাকবে- প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরকে রক্ষা করা দেশপ্রেমের অংশ। আমরা যদি দেশকে ভালোবাসি তাহলে এই খাতকে রক্ষা করতে হবে এর কোন বিকল্প নেই।
সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান বলেছেন, দেশে চলমান শ্রমিক অসন্তোষে চরম বিপাকে দেশের অন্যতম রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। চলমান অস্থিরতায় একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ক্রেতা হারাচ্ছেন শিল্পমালিকরা। পোশাক শিল্পে চলমান এই অস্থিরতার জন্য তিনটি কারণ দায়ী বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, তবে সমাধান না হলে শিল্পের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীর মতে, পোশাক শিল্পে চলমান এ অস্থিরতার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী। এগুলো হলো- বহিরাগতদের আক্রমণ। তবে এখন আর এটা হচ্ছে না। একই সঙ্গে শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ধরে রাখা হচ্ছে। এছাড়া ঝুট ব্যবসার আধিপত্য।
আর শিল্প পুলিশের প্রধান সিবগাতউল্লাহ বলেছেন, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেয়া জরুরি।
দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ নেই উল্লেখ করে হামীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেছেন, সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের অর্ডারগুলো প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। এ কে আজাদ বলেন, শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারছেন না। বহিরাগতরা কারখানাগুলোতে অশান্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কোনো অসন্তোষ নেই। কিছুদিন আগেই প্রায় অর্ধেক বেতন বাড়ানো হয়েছে। মালিকরা সেই বেতন বাস্তবায়ন করছে। এখনো কারখানাগুলোতে গ্যাস বিদ্যুৎ ঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানাগুলোতে পাঁচ ছয় ঘণ্টা করে ডিজেলে চালাতে হচ্ছে। এতে উদ্যোক্তাদের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, কারখানাগুলোতে নিরাপত্তার তীব্র সঙ্কট। সন্ধ্যার পর কারখানাগুলোতে লুটপাট ঠেকাতে পাহারা বসাতে হচ্ছে। পুলিশকে ডাকলে পাওয়া যাচ্ছে না। সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু কারখানা তো অনেক, তারা কয় জায়গায় যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আর্থিক সহায়তার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এই মাসে কোনোভাবে বেতন দিতে পেরেছি। কিন্তু সামনের মাসে ৭৫ হাজার শ্রমিকের বেতন দিতে পারব কি না তা জানি না।
এ কে আজাদ বলেন, দেশের কারখানাগুলোর এই অবস্থার জন্য বিদেশি বায়াররা আসছেন না। আমেরিকা অস্ট্রেলিয়াসহ ৫টি দেশ বাংলাদেশকে ট্রাভেল ব্যান দিয়েছে। অর্ডার প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। ভারতে বিনিয়োগের জন্য সরকার উদ্যোক্তাদের বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন গার্মেন্টস মালিক লুৎফি আইয়্যুব, মাহমুদ হাসান খান বাবু, শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার, মোশারেফা মিশু, মন্টু ঘোষ, আমিরুল ইসলাম আমীন,
উল্লেখ্য, ছাত্র জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের পর বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠী নানা দাবিতে মাঠে নেমেছে। পোশাক ও ওষুধ শিল্পের শ্রমিকরাও ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে নানা দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে পোশাক শ্রমিকদের দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। একেক কারখানায় একেক ধরনের দাবি উঠছে। আবার দাবি মানলেও শ্রমিকদের অসন্তোষ থামছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তরফে শুরুতে উসকানি ও নানা ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়, যৌথ অভিযানও শুরু হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। আর তাই গতকাল সর্বমহলের মতবিনিময় সভায় কারখানা খোলা রাখা এবং কঠোরতার হুশিয়ারি দেয়া হয়।