‘স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। বিদেশের কারাগারে বিভীষিকাময় দিনগুলোতে ভেবেছিলাম, আর হয়তো দেশে ফিরতে পারব না, পরিবারের সঙ্গে কখনও দেখা হবে না। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ইউনূস স্যারের (ড. মুহাম্মদ ইউনুস) প্রচেষ্টায় জেল মুক্ত হয়ে এখন দেশে আছি। তিনি না থাকলে হয়তো কোনোদিন দেশে আসা হতো না।’
শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) কথাগুলো বলছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরাদের একজন। ফরিদ আহমদ শাহিন নামে এই ব্যক্তি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার চৌদ্দগ্রাম পৌর সদরের লক্ষ্মীপুর গ্রামের সন্তান। গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে মুক্তিপ্রাপ্ত ১৪ প্রবাসী দেশে ফেরেন। তাদের মধ্যে ফরিদও ছিলেন।
মাত্র দুই মাস আগের কথা। সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ-আন্দোলনে দেশ যখন উত্তাল, তখন দেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাস্তায় নেমেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। গত ২০ জুলাই সন্ধ্যায় দুবাই, শারজাহ ও আজমানের বিভিন্ন এলাকার সড়কে বিক্ষোভের সময় ৫৭ বাংলাদেশিকে আটক করে আমিরাতের পুলিশ। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, একজনকে ১১ বছর এবং বাকি ৫৩ জনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় স্থানীয় আদালত। এরপর বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সুবিধা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করার ঘোষণা দেয় আমিরাত সরকার। তাদের নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়নি।
পরে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমা পান সেই ৫৭ বাংলাদেশি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই প্রবাসীদের ক্ষমা করে দেন আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
ফরিদ বলেন, আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম স্বৈরাচার হাসিনা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে আর একটাও যেন গুলি না চালায়। প্রায় ২০ বছর ধরে আইন-কানুন মেনে বেশ সুনামের সঙ্গে দুবাইতে ব্যবসা করে আসছি। আমরা জানতাম প্রতিবাদ করলে রাজতন্ত্র আইনে আমাদের শাস্তি পেতে হবে।
এরপরও আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম। পরদিন ওই দেশের পুলিশ আন্দোলনরত বাঙালিদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে। আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো উপায় দেখছিলাম না। সারাক্ষণ পরিবারের দুশ্চিন্তায় সময় কেটেছে। অবিরত চোখের পানি ঝরিয়েছি। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া ছিল, আল্লাহ আমাদের এই অন্ধকার কুঠুরি থেকে মুক্ত করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিক।
তিনি বলেন, কখনো আর পরিবারের সঙ্গে দেখা হবে সে আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আন্দোলন সফল না হলে যদি হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকতো তাহলে জীবনে দেশের মাটিতে আসতে পারতাম না। আমাদের জীবন কাটত দুবাইয়ের জেলে। ৪৫টা দিন আমার কাছে কয়েকশ বছরের মতো লেগেছিল। সময় যেন ফুরাচ্ছিল না। বন্দী থাকা অবস্থায় হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের মুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার আমিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিশ্বাস করুন, সাথে সাথে সিজদায় পড়ে গেছি। তার কয়েকদিন পর শুনলাম আমিরাতের রাষ্ট্রপতি আমাদের সাধারণ ক্ষমা করে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের খবর আমার কাছে সেটিই ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ৫৭ জনকে সাজার খবর প্রকাশিত হলেও সাজাপ্রাপ্তদের প্রকৃত সংখ্যাটা ১১৪। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ করব ৫৭ জনের বাইরেও আরও ৫৭ জনকে সাজার খবর প্রকাশ হয়নি। বিক্ষোভ করতে গিয়ে যেসব বাঙালি প্রবাসের জেলে বন্দি আছেন সবাইকে যেন মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।